Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বখ্যাত চিত্রকর্মগুলোর অজানা কাহিনী

ইতিহাসের সবচেয়ে ধূসর হয়ে যাওয়া, কালের ধুলো জমা পাতাগুলো প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনে পথ চলতে শেখায়। একদা মানুষ যখন আত্মরক্ষার জন্য গুহাবাসী ছিলো, তখন থেকেই সে শিখতে শুরু করেছে তার ভাব প্রকাশের নানা কলা-কৌশল। প্রথম যুগের মানুষের এই উপায়গুলোর একটি ছিল চিত্রকলা। তারপর দিন যত এগিয়েছে, চিত্রকলা বা শিল্প হয়ে উঠেছে মনোরঞ্জনের এক মাধ্যম।

আসলে কি তাই? ছবি শুধুই কি আমাদের মনোরঞ্জনের একটি উপায় মাত্র? একজন চিত্রশিল্পী যখন ছবি আঁকতে শুরু করে, তার মনের মধ্যে কি কোনো ভাবনা বা একান্ত নিজস্ব কোনো ব্যর্থ প্রেম বা আবেগ কাজ করে না? পৃথিবীর সব বড় বড় চিত্রশিল্পীর যেসব চিত্রকলা তাদেরকে স্মরণীয় করে রেখেছে, তার পেছনের ইতিহাস খুবই রোমাঞ্চকর। আজ এমনি কয়েকটি সর্বকালের বিখ্যাত ছবির নেপথ্যে থাকা আকর্ষণীয় সব গল্প জানার চেষ্টা করব।

এক

ছবির নাম: দ্য পারসিসটেন্স অব মেমরি

শিল্পী: সালভাদর দালি

আঁকার মাধ্যম: অয়েল অন ক্যানভাস

দ্য পারসিসটেন্স অব মেমরি; ছবিসূত্র: pinterest

স্প্যানিশ চিত্রশিল্পী সালভাদর দালির ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমরি’ পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় পেইন্টিংগুলোর অন্যতম। এই পেইন্টিং নিয়ে অনেক ছবি সমঝদারদের মধ্যে রয়েছে নানা রকম ব্যাখ্যা।

কিন্তু কোনো ব্যাখ্যাই শেষ পর্যন্ত মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। দালি তার ছবিকে মাঝেমধ্যেই ‘হ্যান্ড পেইন্টেড ড্রিম ফোটোগ্রাফস’ বা ‘হাতে আঁকা স্বপ্নছবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। তার আঁকা ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমরি’তে বেশ কয়েকটি হাতঘড়ি দেখা যায়, যেগুলো গলে গলে পড়ছে বলে মনে হয়।

অনেকে এই চিত্রকলাটিকে ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’র সঙ্গে মিল খোঁজার চেষ্টা করেন। তবে দালির নিজস্ব মত হচ্ছে, আইনস্টাইনের সঙ্গে তার ছবির কোনো যোগসূত্র নেই। তিনি ছবিটি এঁকেছিলেন গরমে চীজ গলে যাওয়া দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে। চীজ গলে যাওয়া দেখে একটি গলে যাওয়া ঘড়ির কল্পনা তার মাথায় এসেছিল তার!

চিত্রশিল্পী সালভাদর দালি; ছবিসূত্র: pinterest

পেইন্টিংটির নাম থেকেও একটি ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। দালি যে বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন, সে বিষয়টির সাথে তার এই ছবির একটি সামঞ্জস্য আছে বলে অনেকে মনে করে থাকেন। সাইকো অ্যানালাইসিস নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন বলেই হয়তো স্বপ্ন নিয়ে ছিল দালির যথেষ্ট পরিমাণে আগ্রহ।

দালি তার এই ছবির মধ্যে দিয়ে হয়তবা স্বপ্নলোকে সময়ের অস্তিত্ব সম্বন্ধে নিজের মনের জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজেছিলেন। কিংবা তিনি হয়তো এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, স্বপ্নলোকে সময় বলে কিছু থাকে না। সময় সেখানে এক অলীক কল্পনা মাত্র। সময়ের অনুপস্থিতিতে স্বপ্নলোকে যেটার অস্তিত্ব থেকে যায়, সেটা হচ্ছে শুধুই স্মৃতি।

মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্ট, নিউইয়র্ক; ছবিসূত্র: Imagini e non solo parole

আর তাই নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্টে সংরক্ষিত থাকা অয়েল অন ক্যানভাসে আঁকা স্পেনের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী সালভাদর দালির ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমরি’ নামটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ।

দুই

ছবির নাম: দ্য র‌্যাফ্ট অব মেডুসা

শিল্পী: থিয়োডর জেরিকো

অঙ্কনের মাধ্যম: অয়েল অন ক্যানভাস

দ্য র‌্যাফ্ট অব মেডুসা; ছবিসূত্র: Art A Fact

১৮১৬ সালে ফ্রান্সের একটি যুদ্ধ জাহাজ মেডুসা সেনেগালের নতুন রাষ্ট্রপ্রধান প্রায় ৪০০ যাত্রী নিয়ে সেনেগালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সেসময় জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন ৫৩ বছর বয়সী ডি চমেরে। ক্যাপ্টেন হিসেবে তিনি তেমন কৌশলী ছিলেন না। লোকমুখে শোনা যায় যে, তখনকার ফরাসি রাজা অষ্টাদশ লুইয়ের সঙ্গে যোগাযোগের কারণেই দক্ষতা না থাকা সত্ত্বেও চমেরেকে ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দেয়া হয়। চমেরের দক্ষতার অভাবে হোক কিংবা অন্য কোনো কারণেই হোক, জাহাজটি নিয়ন্ত্রণ হারায়।

সেই জাহাজে ছিল না পর্যাপ্ত পরিমাণ লাইফবোট। অল্প সংখ্যক লাইফবোট থাকায় কিছু প্রভাবশালী লোক সেই লাইফবোটে জায়গা পায়। অন্য যাত্রীরা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য তড়িঘড়ি করে একটি কাঠের তৈরি ভেলা বানানোর চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার হলো, সেই ভেলায় ওঠা ১৮৯ জন যাত্রীর মধ্যে ১৫ জন ছাড়া বাকিদের পক্ষে বেঁচে ফেরা সম্ভব হয়নি।

চিত্রশিল্পী থিয়োডর জেরিকো। ছবি সূত্র: Live Science

ঐ সময় সমুদ্রে ওঠে প্রচন্ড ঝড়। প্রায় ১৩ দিন পর্যন্ত চলে এই ঝড়-বৃষ্টি। সেই ঝড়-বৃষ্টি পেরিয়ে যাদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়, তখন তারা মৃতপ্রায়। এই ঘটনার ফলে তৎকালীন ফরাসি সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নিয়ে প্রবল সমালোচনার ঝড় ওঠে।

এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনারই ক্যানভাসে চিত্ররূপ দেন ফরাসি রোমান্টিক শিল্পী থিয়োডর জেরিকো তার বিখ্যাত পেন্টিং ‘র‌্যাফ্ট অব মেডুসা’য়। এটি আঁকার আগে থিয়োডর ঘটনাটি নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করেছেন বলে তিনি জানিয়েছিলেন। এমনকি হাসপাতালে গিয়ে মৃত মানুষের চামড়ার রঙ নিয়ে পর্যন্ত গবেষণা করেছিলেন। এঁকেছিলেন একটার পর একটা স্কেচ।

শুধু তাই নয়, একটি ভেলা বানিয়ে তা সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন তার উঠানামা লক্ষ্য করার জন্য। এতে ফলও পান খুব দ্রুত। বর্তমানে ছবিটি প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।

লুভর মিউজিয়াম, প্যারিস। ছবি সূত্র: Live Science

ঘটনাটি সকলের জানা থাকায়, তার সাথে যুক্ত হয় জেরিকোর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। জেরিকোর পেন্টিংয়ের স্টাইলও ছিল বেশ জোরালো। ফলে এই পেন্টিংটা বিখ্যাত হতে বেশি সময় লাগেনি। মাত্র ১৬টি রঙ, বিশেষত কালো, হলুদ ও কমলা রঙ দিয়ে আঁকা হয়েছিল জেরিকোর এই স্বনামধন্য চিত্রকর্মটি। যেহেতু জেরিকো মাইকেলেঞ্জেলোর কাছ থেকে খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, তাই তার ছবিটির সঙ্গে ‘সিস্টিন চ্যাপেল’ ছবিটির সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

তিন

ছবির নাম : দুর্ভিক্ষ

শিল্পী: জয়নুল আবেদীন

অঙ্কনের মাধ্যম: স্কেচ, কালো কালি

‘দুর্ভিক্ষ’, শিল্পী জয়নুল আবেদীন

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বাংলাদেশের চিত্রকলার এক মুকুটহীন সম্রাট। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই চিত্রশিল্পী আজীবন লড়াই করেছেন এ দেশের শিল্পচর্চার প্রতিকূল পরিবেশ, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, মুক্তিযুদ্ধসহ সব অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে। তার আঁকা চিত্রগুলো যেন তারই দিনলিপি। তিনি তার দৈনন্দিন জীবনে যা অবলোকন করেছেন, তা-ই কাগজ-ক্যানভাসের চিত্রকলার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। তেমনি এক অসাধারণ চিত্রকর্মের নাম ‘দুর্ভিক্ষ’।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন

১৯৪৩ সালে সারা বাংলায় ঘটেছিল ব্যাপক দুর্ভিক্ষ যা তেতাল্লিশের মন্বন্তর নামে পরিচিতি লাভ করে। এ সময় মহানগরী কলকাতায় ঘটে মানবতার চরম অবমাননা। ডাস্টবিনের পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট নিয়ে মানুষ আর কুকুরের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ও সংগ্রামের অমানবিক দৃশ্য দেখে প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত, আতঙ্কিত ও আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন ঊনত্রিশ বছর বয়সী জয়নুল। তিনি তার এই আবেগকে শিল্পরূপ দিতে মনোযোগী হন। তার অসামান্য মুন্সিয়ানায় ক্যানভাসে তুলে ধরেন অমানবিক পরিস্থিতির এক মানবিক নির্মাণ। তিনি কলকাতার দুর্ভিক্ষের সেসব নারকীয় দৃশ্যাবলির পরপর স্কেচ করতে থাকেন।

দুর্ভিক্ষের নারকীয় দৃশ্যাবলী

ছবিগুলোতে তিনি আঁকলেন কাক ও কুকুরের সঙ্গে বুভুক্ষু মানুষ ডাস্টবিন থেকে খাবার খাচ্ছে। মানুষের লাশের ওপর বসে মাংস খাচ্ছে কাক ও শকুন। তিনি আঁকলেন ফুটপাতে, রাস্তায় পড়ে থাকা নিরন্ন ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি। সেসময় জয়নুল ছিলেন আর্ট স্কুলের একজন সামান্য আয়ের শিক্ষক। শিল্পসামগ্রী তখন যেমন ছিল দুর্লভ তেমনি ছিল দুর্মূল্য। সে কারণে তিনি বেছে নেন শুধু কালো কালি আর তুলি।

কালি ও তুলিতে ফুটিয়ে তোলা দুর্ভিক্ষের নির্মম ছবি

শুকনো তুলিতে কালো চীনা কালির টানে স্কেচ করতে থাকেন অতি সাধারণ সস্তা কাগজের ওপর। ব্যবহার করেছেন কার্টিজ পেপার। এসব কাগজ ছিল ঈষৎ পীত বর্ণের। সাধারণ স্বল্পমূল্যের এসব অঙ্কন সামগ্রী ব্যবহার করে তিনি যে শিল্প সৃষ্টি করলেন তাই পরিণত হলো অমূল্য সম্পদে।

ক্ষুধার্ত ভিক্ষারত নারী

দুর্ভিক্ষ নিয়ে জয়নুলের এই বাস্তব দৃশ্যাবলি সমৃদ্ধ অঙ্কিত চিত্রকর্মের কোনো পূর্ব দৃষ্টান্ত উপমহাদেশের চিত্র ঐতিহ্যে ছিল না। জয়নুলের দুর্ভিক্ষের স্কেচগুলো দেখার পর ‘ভারতের নাইটিঙ্গেল’ শ্রীমতি সরোজিনি নাইডু মন্তব্য করেছিলেন, “সব চাইতে মর্মস্পর্শী ও আবেগময় বর্ণনার চাইতেও তার এসব ছবির আবেদন অধিকতর।” ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে সে বছরই কলকাতায় যে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে জয়নুল তার দুর্ভিক্ষ নিয়ে অংশগ্রহণ করেন।

দুর্ভিক্ষের আর্তনাদ

‘দুর্ভিক্ষ’ সিরিজ ছবিটির সুবাদে ১৯৪৪ সালের সমকালীন চিত্রশিল্পীদের মাঝে মাত্র ত্রিশ বছরের জয়নুল অনেক উঁচু স্থান অর্জন করেন। ‘দুর্ভিক্ষ’ ছবিটিতে আরো একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, তা হলো রেখার আধিপত্য। চিত্রকর্মগুলো ছিল বাহুল্যবর্জিত, সরল ও রেখাপ্রধান। স্বল্প ও মৌলিক রঙের ব্যবহারে  স্বতন্ত্র চিত্রপট ফুটে ওঠে এই রেখাচিত্র দ্বারা। জয়নুল আবেদীনের চিত্রকর্মটি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালা; ছবিসূত্র: bn.wikipedia.org

দেশ-বিদেশের এসব বিখ্যাত শিল্পীর বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর্ম আর তা তৈরির ইতহাস আমাদের সবাইকে যেমন বিমোহিত করে, তেমনি করে রোমাঞ্চিত। এ ধরনের আরো বিখ্যাত সব চিত্রশিল্পীদের তাদের অবিস্মরনীয় চিত্রকর্ম নিয়ে আলোচনার ইচ্ছে রইলো।

তথ্যসূত্র

১) en.wikipedia.org/wiki/The_Persistence_of_Memory

২) bn.wikipedia.org/wiki/জয়নুল_আবেদীন

৩) moma.org/learn/moma_learning/1168-2

৪) en.wikipedia.org/wiki/The_Raft_of_the_Medusa

৫) mentalfloss.com/article/66839/15-things-you-should-know-about-raft-medusa

Related Articles