Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এক বৃক্ষ মানবের গল্প

এক মায়ের আকুল প্রার্থনা কি সৃষ্টিকর্তা শুনেছেন তবে? সেই অসহায় মায়ের হৃদয় বিদারক আকুতি তার একমাত্র সন্তানকে কবে সে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পাবে, কবে তার নাতনীটি প্রাণপ্রিয় বাবার কোলে বসে গল্প শুনতে পারবে। সে অসম্ভবকে সম্ভব করবার সে সত্য গল্পটি শুনি।

আবুল বাজনদার, বয়স ২৫। এক দরিদ্র ভ্যান চালক। বাংলাদেশের দক্ষিণের খুলনার পাইকগাছার অধিবাসী। পিতৃহীন আবুল মায়ের অন্ধের যষ্টি। ছোট্ট সংসারে সেই একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি। চোখের সামনে ছেলের কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিলেন না আবুলের মা। তাই পুত্রবধু, নাতনী আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে ৬ ঘণ্টা বাসে চেপে অজানা আশার আলোর স্বপ্নে বিভোর মা এসেছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দরজায়।

যদি একটু আশার আলোর সন্ধান পাওয়া যায়, যদি ভাগ্যে মেলে তার একমাত্র ছেলেকে আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার টিকেট। পাড়ার লোকেরা সেই মায়ের অসহায়ত্বে শুধু সান্ত্বনার বাণী শুনিয়েই ক্ষান্ত দিয়েছিলেন। কারণ এ রোগের তো তেমন তো কোন চিকিৎসা নেই। অনেক মুরব্বি তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। কী হয়েছিল আসলে আবুলের?

আবুল বাজনদার, তার মা ও স্ত্রী

আবুল বাজনদার, তার মা ও স্ত্রী

আবুল জানান, যখন তার বয়স ১৫, তখন থেকেই তিনি জীবন যুদ্ধের এই বাঁচা-মরার সংগ্রামের অগ্নি পরীক্ষা দিচ্ছেন। ১৫ বছর বয়সেই হঠাৎ তার গোচরে এল যে তার হাতে, পায়ে শক্ত কিছু গাছের বাকলের মত  বের হয়ে আসতে চাইছে। নিজেকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না। আসলে কী হচ্ছে তার শরীরে, নাকি আতংক! একে তো টানাটানির সংসার। তার উপর এত অসুখ-অসুখ করলে হবে কী করে? তাই বিষয়টা পাত্তা না দিয়ে দিনাতিপাত করতে থাকেন স্বাভাবিকভাবে। ঘুণাক্ষরেও তিনি বা তার পরিবার বুঝতেই পারে নি যে, আবুলের শরীরে বাসা বেঁধেছে ‘এপিডার্মোডাইস্প্লাসিয়া ভেরুসিফর্মিস’ নামের এক অদ্ভুত রোগ। ক্রমশ দিন যেতে থাকল আর এই রোগের আবাসস্থল আরও পোক্ত ভাবে দানা বেঁধে বাড়তে শুরু করল আবুলের শরীরে।

ট্রি ম্যান সিনড্রমের একাংশ

ট্রি ম্যান সিনড্রমের একাংশ

যখন ঢাকা মেডিক্যালের শরণাপন্ন হলেন তখন তার অবস্থা ঠিক একজন গাছ মানবের রূপ। হাতের আঙ্গুল ভেদ করে সুন্দরবনের গাছের ঠেস মূলের শিকড়ের মত অনেক অংশ বের হয়ে এসেছে। হাতে কিছু ধরার বা খাবার খাওয়ার মত অবস্থা তার ছিল না তখন। এমনকি পায়েও একই ভাবে শিকড় গজাতে শুরু করেছে। আবুলের ভাষ্যমতে, “শিকড়গুলো আমাকে অস্বস্তিকর, অস্থির আর অসহায় অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছিল, আমি এক জায়গায় থাকতে বা দাঁড়াতে পারছিলাম না, নিজেকে পাগল মনে হতে লাগল, হতাশা আমাকে ঘিরে ধরেছিল। ভেবেছিলাম আমি আর বোধ হয় বেশিদিন এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারব না। আমি যেমন পিতৃহারা অসহায় মাতার একমাত্র সম্বল, তেমনি হয়ত আমার মেয়েটাও তার পিতা কে হারাতে চলেছে ,ঠিক আমারই মত।”

আবুলের মা সেদিন বলেছিলেন, তিনি তার ছেলের জন্যে সম্ভাব্য সর্বোত্তম চিকিৎসা পেতে ঢাকায় এসেছেন। এক অসহায় মায়ের সেদিনের প্রার্থনা ছিল, “যদি আবুল সুস্থ হয়ে উঠে তবে সে পরিবারটি দেখাশুনা করতে পারবে, অর্থ উপার্জন করে তার সন্তানকে মানুষ করতে পারবে, আগের মত সকলের সাথে আবার মিশতে পারবে।”

আবুল বাজনদার পরিবার

আবুল বাজনদার পরিবার

আবুল বাজনদারের স্ত্রী হালিমা খাতুন। আবুলের সাথে তার পরিচয় তার বৃক্ষ মানব বৈশিষ্ট্য প্রকট হওয়ার আগেই। তার রোগ প্রকট হতে থাকলে হালিমার পিতা আবুলের সাথে তার সম্পর্কটি মেনে নেননি। তার অমতেই, ভালোবাসার টানে তারা বিয়ে করে। এই দম্পতির কোল জুড়ে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান আসে। মানুষ তার সন্তানকে আঁকড়ে ধরেই নতুনভাবে বাঁচতে চায়।আবুল ও সৃষ্টিকর্তার কাছে এর ব্যতিক্রম কিছু চায়নি।

অবশেষে মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় সরকারের সহযোগিতায় আবুল বাজনদারের চিকিৎসার বন্দোবস্ত হয়। যত দিন পর্যন্ত আবুল বাজনদারের চিকিৎসা প্রয়োজন হবে, তত দিন পর্যন্ত চিকিৎসার ব্যয় সরকার বহন করবে এই আশ্বাস দেওয়া হয়। বৃক্ষমানব আবুল বাজনদারের প্রথম অস্ত্রোপচার শুরু হয় ২০১৬ সালের ২০ ডিসেম্বর, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আবুল কালামের নেতৃত্বে চিকিৎসকদের একটি দল আবুল বাজনদারের ডান হাতে পাঁচটি আঙুলেই অস্ত্রোপচার করে। সেদিন সকাল সোয়া নয়টা থেকে দুপুর সোয়া ১২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় আবুলের অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে মোট ১৫ বার অস্ত্রোপচার শেষে চিকিৎসকরা পুরোপুরিই সফল হন। প্রায় ৫কেজি মত শেকড় সরানো হয় তার শরীর থেকে। জানা যায়, চিকিৎসা পরবর্তী সময়ে বাজনদারের আর নতুন করে সে রকম কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি।

আবুল বাজনদার সুস্থ হওয়ার পর তার সন্তানের সাথে।

আবুল বাজনদার সুস্থ হওয়ার পর তার সন্তানের সাথে।

চিকিৎসকেরা বলছেন, আবুল বাজনদারসহ বিশ্বে এখন পর্যন্ত এ ধরনের চারজন রোগীকে শনাক্ত করা হয়েছে। গণমাধ্যমে এসেছে, ইন্দোনেশিয়ার বৃক্ষমানব মারা গেছেন। ‘এপিডার্মোডাইস্প্লাসিয়া ভেরুসিফর্মিস’ রোগটি ‘ট্রি-ম্যান’ (বৃক্ষমানব) সিনড্রম নামেও পরিচিত। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এ রোগ হয়। ১০ বছর ধরে আবুল এই রোগে ভুগছিলেন। ঢাকা মেডিকেলে আসার আগেও তিনি আরেক হাসপাতালে চিকিৎসারত ছিলেন। কিন্তু কোনো উন্নতি না দেখেই তার মা তাকে সাথে করে শেষ চেষ্টার লক্ষ্যে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসেন।

ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা আবুলের বায়োপসি পরীক্ষায় ক্যানসারের কোনো অস্তিত্ব পাননি। তবে যা পেয়েছেন সেটি হল হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস,এটি ও কম ঘাতক নয়। তাছাড়া হেপাটাইটিস বি ভাইরাসেরও সংক্রমণ ও ছিল। ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে গায়ে ব্যথা, ম্যাজম্যাজ করাসহ বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছিল তার। এর বাইরে ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্বও ছিল। এই  রোগের চিকিৎসায় অনেক ব্যয়বহুল অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধের প্রয়োজন পড়ে। যা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করেছে।  এছাড়া অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের চিকিৎসকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল আবুলের চিকিৎসকদের।

ইন্দোনেশিয়ার ট্রি ম্যান ডিডি কসোয়ারা

ইন্দোনেশিয়ার ট্রি ম্যান ডিডি কসোয়ারা

২০০৮ সালে ডিসকভারি চ্যানেলে ইন্দোনেশিয়ান ট্রি ম্যান ডিডি কসোয়ারাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ডিডি কসোয়ারা চিকিৎসা শেষে ঘরে ফিরে গিয়েছিলেন ঠিক, কিন্তু কিছুদিন পর থেকেই আবার নতুন করে সেই ট্রি ম্যান সিনড্রম দেখা দেয়, যার ফলে বেশিদিন সে বেঁচে থাকতে পারে নি। জানা যায়, তার শরীর থেকে প্রায় ৬ কেজি শেকড় অপারেশান করে সরাতে সক্ষম হয়েছিল ডাক্তাররা।

 ডি ডি কসোয়ারা

ডি ডি কসোয়ারা

কসোয়ারা তার এই রোগের কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছিল। তার স্ত্রী সন্তান তার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরও তিনি সপ্ন দেখতেন যে সুস্থ হওয়ার পর আবার কারপেন্টারের কাজ শুরু করতে পারবে। একেবারেই শেষ পর্যায়ে হতাশ হয়ে দ্রুত মৃত্যু কামনায় ধূমপান শুরু করলেন দিন রাত। তার জন্যে পরবর্তিতে মিডিয়ার সহযোগিতায় অনেক সাহায্য আসলেও অদৃষ্ট তার সহায় ছিল না। পৃথিবীর মায়া তাকে নিয়ে যায় না ফেরার দেশে।

আমাদের চাওয়া, কসোয়ারার পরিণতি যেন আবুল বাজনদার জীবনে না ঘটে। সুস্থ স্বাভাবিকভাবে তিনি তার জীবনযাপন করুন। তার পরিবার, সমাজ সকলের ভালবাসায় সন্তানকে বড় করে তুলুন, সে প্রত্যাশা আমাদের সকলের।

Related Articles