Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়: ট্রান্স আটলান্টিক দাস ব্যবসা

আমেরিকায় এত বিপুল সংখ্যক কালো চামড়ার সেলিব্রেটি দেখে আপনার মনে কখনও কি প্রশ্ন জেগেছে? জানতে ইচ্ছে করেছে কি সাদা চামড়ার মানুষের উপনিবেশ আমেরিকায় কী করে এল এতগুলো কালো মানুষ? সেই প্রশ্নেরই উত্তর দিয়ে সাজানো হয়েছে এই প্রতিবেদনটি। আমেরিকায় কালো মানুষের আগমনের ইতিহাস লাঞ্ছনার ইতিহাস, শোষণের ইতিহাসে, দাসত্বের ইতিহাস এবং সেই ইতিহাস দাসপ্রথার এক কলঙ্কজনক দৃষ্টান্ত। এই প্রতিবেদনে আপনাকে জানাতে চেষ্টা করব কিছু নির্মম সত্য, উন্মোচন করব এক নিষ্ঠুর অধ্যায়, বলব কিছু হতভাগ্য মানুষের করুণ গল্প।

যেভাবে শুরু হল দাসব্যবসা

১২ অক্টোবর ১৪৯২। মানব সভ্যতার গতিপথ বদলে দেওয়ার মত একটি দিন। এই দিনে আমেরিকার মাটিতে পা রাখেন ক্রিস্টোফার কলাম্বাস। সেদিন থেকে সূচনা হল ইতিহাসের নতুন এক বাঁকের। ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপালের মত ইউরোপীয়রা ছুটে আসতে শুরু করল সদ্য আবিষ্কৃত এই মহাদেশে। স্থানীয় আদিবাসীদের একটু একটু করে সরিয়ে দিয়ে দখল করতে লাগল তাদের জমি। ইউরোপের মানুষের কাছে এত উর্বর জমি যেন কল্পনার অতীত। প্লেগ ও কুসঙ্কারে আচ্ছন্ন তৎকালীন ইউরোপে আবাদি জমির ছিল বড্ড অভাব। তাই এই সুযোগ লুফে নিতে শুরু করল ইউরোপবাসী। একই সাথে শুরু হল ব্যাপক কৃষিকাজ এবং স্থানীয়দের উপর অত্যাচার। কিন্তু সমস্যা হল এই বিশাল দুটি মহাদেশের হাজার হাজার মাইল অনাবাদি জমি আবাদ করার মত জনবল তাদের ছিলনা। সেই সমস্যার পৈশাচিক  সমাধান বের করা হল আফ্রিকা থেকে লাখ লাখ মানুষকে দাস হিসাবে ধরে এনে। আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্থাৎ আমেরিকায় দাস ধরে আনার এই ব্যবসা ইতিহাসে ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড হিসাবে পরিচিত।

দাস ব্যবসার সময়কাল ও পরিসংখ্যান

ইউরোপ থেকে দাস বোঝাই প্রথম জাহাজটি আমেরিকায় পৌছায় ১৫০২ সালে। সেটি ছিল একটি স্প্যানিশ জাহাজ। শুরুর দিকে দাস ব্যবসা পুরোপুরি ছিল পর্তুগীজ এবং স্প্যানিশদের হাতে। সময়ের সাথে সাথে ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, ফ্রান্স সমানতালে এই ব্যবসায় জড়িয়ে পরে। ষোড়শ শতকের শুরু থেকে আরম্ভ হওয়া দাস ব্যবসা উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশ বছর ধরে চলতে থাকে। এই সময়ে আফ্রিকার প্রায় দেড় কোটি থেকে দুই কোটির মত নারী, পুরুষ ও শিশুকে দাস বানিয়ে ধরে আনা হয়েছিল। যাদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই মারা পড়েছিল সমুদ্র পথে নিয়ে আসার সময়, তাদের উপর করা অত্যাচারে কিংবা ক্ষুৎপিপাসা ও রোগ শোকে। প্রায় ৮০ লক্ষের মত দাস আনা হয়েছিল শুধু ব্রাজিলেই আর ৪ লক্ষ যুক্তরাষ্ট্রে বাকিদের হাইতি ও ক্যারিবীয় অন্যান্য দ্বীপগুলোতে পাঠানো হয়েছিল।

যেখান থেকে ধরে আনা হত হতভাগ্য দাসদের

মূলত দাস ব্যবসার কেন্দ্রস্থল ছিল পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চল যেটা সেনেগাল থেকে অ্ঙ্গোযালা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দাস ব্যবসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো ছিল বেনিন, টোগো এবং নাইজেরিয়ার পশ্চিম উপকূলে। তাই এলাকাগুলোকে স্লেভকোস্ট বা দাসের উপকূল বলা হত। যুদ্ধবন্দী, অপরাধী, ঋণগ্রস্ত ও বিদ্রোহীদেরকে স্থানীয় আফ্রিকানদের কাছ থেকে দাস হিসাবে কিনে নিত ইউরোপীয় দাস ব্যবসায়ীরা। এছাড়া অনেক সাধারণ মানুষকেও দাস ব্যবসায়ীরা অপহরণ করে দাস হিসাবে বেচে দিত। মোট ৪৫টির ছোট বড় জাতিগোষ্টি থেকে দাস ধরে আনা হত। এদের বেশির ভাগই ছিল আদিবাসী বা আফ্রিকার স্থানীয় সংস্কৃতির অনুসারী।

দাস ব্যবসার পথ

দাস ব্যবসার পথ; Image courtesy: www.un.org

দাসদের জীবন ও মানবিক পরিস্থিতি

দাসদের ধরে আনা হত জোর করে তাই তাদের বাধ্য করার জন্য বিভিন্ন রকম অত্যাচার করা ছিল দাস ব্যবসায়ীদের কাছে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তার উপর বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা পড়ত সমুদ্র পথে আটলান্টিক পাড়ি দেওয়ার সময়। জাহাজগুলোতে খরচ বাচার জন্য গাদাগাদি করে মানুষ উঠানো হত, থাকতনা স্যনিটেশনের ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত খাবার। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিত হত আমেরিকায় নিয়ে আসার পর। সেখানকার সিজনিং ক্যাম্পগুলোতে প্রায় এক তৃতীয়াংশ দাস মারা পড়ত ডায়রিয়া ও আমাশয়ে। অনেকে এই অপমানের গ্লানি থেকে বাঁচতে পালানোর সময় মারা পড়ত কেউবা করত আত্মহত্যা। দাসরা বিবেচিত হত প্রভুর সম্পত্তি হিসাবে। যদিও সুদূর অতীত থেকেই দাসপ্রথার প্রচলন ছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তে তবে কোথাও অমানবিকতা আমেরিকান দাসপ্রথাকে অতিক্রম করতে পারেনি। আমেরিকান ভূমি মালিকদের কাছে দাসরা ছিল কেবল কৃষি কাজের মাংসল যন্ত্র।

শেকলবন্দী স্বাধীনতা

শেকলবন্দী স্বাধীনতা; Image courtesy: www.pinterest.com

দাস ব্যবসা ও অর্থনীতি

শিল্পবিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত ইউরোপীয় কলোনিগুলোর অর্থনীতি ছিল দাস নির্ভর। উত্তর আমেরিকার তুলা এবং ব্রাজিল ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের চিনি ছিল ইউরোপের বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রধান অর্থকড়ি ফসল। ভারত থেকে আনা চা পান করার জন্য ক্যারিবীয় অঞ্চলের চিনির তখন সারা ইউরোপ জুড়ে কদর। চিনির বৈশ্বিক বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য তখন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগীতা। বলা হয়ে থেকে আমেরিকার কার্পাস তুলা থেকেই নাকি সূচনা হয়েছিল ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের। আর সেই তুলা থেকে বানানো সাদা কাপড়ের নীল জোগান দেওয়া হত আমাদের দেশ থেকেই। সে আরেক নিষ্ঠুরতার ইতিহাস। তবে শিল্প বিপ্লবের পর থেকে দাস ব্যবসার অর্থনৈতিক আবেদন কমে যেতে থাকে তাই উনবিংশ শতক থেকে বিভিন্ন জায়গায় দাবি উঠতে থাকে দাস প্রথা বিলোপ করার।

আখ খেতে চাষী হিসাবে কালো মানুষ www.abc.net.au

আখ খেতে চাষী হিসাবে কালো মানুষ; Image courtesy:www.abc.net.au

দাস প্রথার বিলোপ

রাষ্ট্রীয়ভাবে দাস প্রথা সর্বপ্রথম বিলুপ্ত ঘোষণা করে ইংল্যন্ড ১৮০৭ সালে। তারপর একে একে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোও বিলুপ্ত ঘোষণা করা হতে থাকে দাস ব্যবসা। সর্বশেষ দেশ হিসাবে দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করেছিল ব্রাজিল ১৮৩০ সালে। তবে অবৈধ দাস ব্যবসা বন্ধ হতে ১৮৬০ এর দশক পর্যন্ত সময় লাগে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ ও দাসপ্রথা গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।

এক দাসীর করুণ আকুতি আমি কি আরও বোন নই? source: wikipedia

এক দাসীর করুণ আকুতি আমি কি আরও বোন নই?; Image Courtesy: wikipedia

দাস প্রথার সুদূরপ্রসারী প্রভাব

বর্ণবাদ সৃষ্টির জন্য দাস ব্যবসাকে প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কালো মানুষ কুৎসিত, মাথামোটা, আবেগী, পেশীসর্বস্ব এই সব অপপ্রচার কয়েক শতাব্দী ধরে সাদা মানুষ চলিয়েছিল তাদের অন্যায় আধিপত্যকে বৈধতা দেওয়ার জন্য। সেই মানসিকতা আজও অনেক মানুষের মাঝে রয়ে গেছে। বর্ণবাদ ছাড়াও দীর্ঘকাল দাস ব্যবসার ফলে আফ্রিকায় মানব শক্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল যার ফলশ্রুতিতে উনবিংশ শতকে ইউরোপীয় কলোনিয়াল শক্তিগুলো একে একে দখল করতে লাগল আফ্রিকার দেশগুলো। ছাড়া ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের পেছনে আমেরিকার দাস ভিত্তিক অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

কেমন আছে দাসদের প্রজন্ম?

ব্রাজিলের ছন্দময় ফুটবল কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মারদাঙ্গা ক্রিকেট কার না ভাল লাগে বলুন? ওয়েস্ট ইন্ডিজের গেইল, ব্রাভোরা কিন্তু সেই ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেডের সময় ধরে আনা দাসদের বংশধর। ব্রাজিলের কালো মানিক পেলের পূর্বপুরুষও কিন্তু ছিলেন দাস। এছাড়া পৃথিবীর দ্রুততম মানব উসাইন বোল্টেরও কিন্তু আদিপুরুষ আফ্রিকান। তুলনামূলকভাবে বেশি শক্তিশালী দাসরাই শুধু আটলান্টিক পাড়ি দিতে সক্ষম হত এবং কঠোর পরিশ্রম করে ঠিকে থাকতে পারত। বংশগতির সূত্রমতে তাদের সন্তানরাও হত তাদের মতই শক্তিশালী ও কষ্টসহিষ্ণু। ক্রীড়াঙ্গনে আফ্রো-আমেরিকানদের ব্যাপক সাফল্যের কারণ কিন্তু এটাই।

ব্রাজিলের কালো মানিক পেলে source: www.emaze.com

ব্রাজিলের কালো মানিক পেলে; Image courtesy: www.emaze.com

দাসী থেকে ফার্স্ট লেডি!

enhanced-buzz-wide-18014-1424903343-7

মিশেল ওবামার পূর্ব পুরুষরা ছিলেন আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় আনা দাস!; Image courtesy:img.buzzfeed.com

আমেরিকার বর্তমান ফার্স্ট লেডী মিশেল ওবামার পূর্ব পুরুষেরা দাস হিসাবে এসেছিলেন আমেরিকায়। অথচ অবাক করা ব্যাপার তাদের বংশধর আজকে আমেরিকার ফার্স্ট লেডী। এছাড়া সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী কনডোলিৎসা রাইসের প্রমাতামহকে মাত্র ৪ বছর বয়সে দাসী হিসাবে বিক্রি করা হয়েছিল সাড়ে চারশ ডলারে। এছাড়া অপ্রাহ উইনফ্রে, অভিনেতা মরগ্যান ফ্রিম্যান ও বক্সার মোহাম্মদ আলীর মত কিংবদন্তীদের পূর্বপুরুষ দাস হিসাবেই এসেছিলেন আমেরিকায়। সত্যি নিয়তির কি খেলা বড় বিচিত্র। সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যা  বেলা

মিস রাইসের পূর্ব পুরুষও ছিল দাস; Image courtesy: img.buzzfeed.com

ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। নির্মমতা ও পাশবিকতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ এই কদর্য প্রথা উপনিবেশিক শক্তিগুলোর কুৎসিত রূপ হিসাবে আজও রয়ে গেছে ইতিহাসে। মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, স্বাধীনতা তার জন্মগত অধিকার। কিন্তু কোটি কোটি আফ্রিকানের জীবন ও স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে লোভী ইউরোপীয় বেনিয়াদের খপ্পরে পড়ে। তাই তাদের কাহিনী না জানলে মানব ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় অজানাই থেকে যাবে আপনার কাছে।

 

Related Articles