Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইতিহাসের সাক্ষী পাঁচ গাছ

গাছ শব্দটির মধ্যে কোথাও যেন একটা জীবনের ঘ্রাণ রয়েছে। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসুর হাত ধরে গাছের প্রাণ ও অনুভূতির উপস্থিতি আজ আর নতুন করে ভাবনার রসদ জোগায় না। তবুও গাছের সাথে যেন সুনিবিড় সম্পর্ক আমাদের। সামান্য গাছ বিহীন এলাকা হলেই অক্সিজেন এর অভাব আর জীবনের নাভিশ্বাস নিয়ে তর্ক বিতর্কের অন্ত রাখি না। আজ কাল তাই গাছ লাগাও স্লোগান আর কর্মসূচী নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার মাত্র।

ঘরের সামনের বাগানের সদ্য ফোটা ফুলটা দেখলে মন কতই না আনন্দে মেতে ওঠে।  আবার পারিবারিক পরম্পরায় অনেক গাছ সাক্ষী হয়ে থাকে অনেক বাস্তব গল্পের। তেমনি ইতিহাসের সাথে গাছের সম্পর্ক সুনিবিড় এবং চিরন্তন। অনেক গাছ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের ধারক ও বাহক তা আজ আর বলতে দ্বিধা নেই। আজ তেমনি পাচটি গাছের কথা বলতে যাচ্ছি যার সাথে রয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার যোগ।

জাপানি চেরি ট্রি, ওয়াশিংটন ডিসি

যারা ওয়াশিংটন ডিসি তে বেড়াতে গিয়েছেন বা কিছুটা হলেও জানেন তাদের কাছে এর চত্বরে টাইডাল বেসিনের চেরি গাছগুলো সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। এই গাছগুলোতে চেরি ফুল যখন ফুটে রঙিন হয়ে ওঠে তখন বোঝা যায় বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। এই চেরি গাছগুলো দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি এর পেছনে রয়েছে এক সৌহার্দের ইতিহাস।

জাপানি চেরি ট্রি, ওয়াশিংটন ডি সি

জাপানি চেরি ট্রি, ওয়াশিংটন ডি সি

১৯১২ সালের ৭ মার্চ টোকিওর মেয়র ইয়ুকিও ওজাকি ওয়াশিংটনকে উপহারস্বরূপ তিন হাজার চেরি গাছ পাঠান দুদেশের মধ্যে মৈত্রীর সম্পর্ক এগিয়ে নিতে।  পরে একাধিকবার উপহার বিনিময় হয় এই দুদেশের মধ্যে কিন্তু এই চেরি গাছ আদান প্রদান এর ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হয় চেরি ব্লসম ফেস্টিভ্যাল। চার সপ্তাহ ধরে চলে এই উৎসব। ২০১২ সালে খুব ধুম ধামের সাথে চেরি গাছের এই উৎসবের শত বৎসর উদযাপন করা হয়। সত্যি চেরি গাছের পেছনে যে লুকিয়ে রয়েছে কত আবেগ আর স্মৃতি।

ইমান্সিপেশন ওক, ভার্জিনিয়া

ইমান্সিপেশন ওক গাছটির রয়েছে এক ঐতিহাসিক তাৎপর্য। আমেরিকার ভার্জিনিয়ায় অবস্থিত হাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে এই গাছটি। ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকান সিভিল ওয়ার-এর সময় ফোর্ট মনরো ছিল আফ্রো-আমেরিকান দাসদের কাছে মুক্তির জায়গা। ১৮৬১ সালে ‘আমেরিকান মিশনারি এ্যাসোসিয়েশন’ মেরি স্মিথ পিককে অনুরোধ করে এই সদ্যমুক্ত ক্রীতদাসদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোর জন্য।  এই ওক গাছটির নিচেই শুরু হয় ক্রীতদাসদের প্রথম পাঠশালা।

ইমান্সিপেশন ওক, ভার্জিনিয়া

ইমান্সিপেশন ওক, ভার্জিনিয়া

পরবর্তীতে এই গাছটি আরও মূল্যবান কিছু ঘটনারয় সাক্ষী হয়ে যায়। ১৮৬৩ সালে এই গাছটির নিচেই অসংখ্য আফ্রো-আমেরিকান মানুষ একত্রিত হন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের বিখ্যাত সেই দাসমুক্তির ওপর ভাষণ শোনার জন্য। এর পর থেকেই গাছটি পরিচিত হয়ে আসছে ‘মুক্তির ওক গাছ’ হিসেবে যেটি দাসবিরোধী ও বর্ণবাদ বিরোধী ইতিহাসের প্রতিবাদ চিহ্ন হিসেবে এখনও স্থির দাঁড়িয়ে আছে।

অ্যানা ফ্রাঙ্ক চেস্টনাট ট্রি, আমস্টারডাম

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জার্মানির প্রবল আগ্রাসনের কবলে নেদারল্যান্ডস। নাৎসিদের থেকে প্রাণে বাঁচতে বিভিন্ন পরিবার গোপন আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। জার্মান লেখিকা অ্যানা ফ্রাঙ্ক তখন অনেক ছোট। সে ও তার পরিবার প্রাণে বাঁচতে আশ্রয় নেয় একটি গোপন ডেরায়। পরে এই বাড়িটি অ্যানা ফ্রাঙ্ক হাউজ নামে পরিচিতি পায়। এই বাড়িটিতে এমনই সুব্যবস্থা ছিল যে ঘরের সদর দরজা ঢেকে রাখা হয়েছিল বইয়ের আলমারি দিয়ে। এই বাড়ির জানালা দিয়ে দেখা যেত একটি চেস্টনাট ট্রি। অ্যানার বিবর্ণ সময় কাটত সেই গাছটির দিকে নিষ্পলক চেয়ে থেকে। এই গাছটির দিকেই তাকিয়ে থেকেই হয়তো তিনি খুঁজে নিতেন স্বাধীনতার অপূর্ণ ইচ্ছে।

বাড়ির জানালা দিয়ে দেখা অ্যানা ফ্রাঙ্কের চেস্ট নাট ট্রি

বাড়ির জানালা দিয়ে দেখা অ্যানা ফ্রাঙ্কের চেস্ট নাট ট্রি

ডায়রি লেখার অভ্যাস ছিল অ্যানার। তিন তিনবার গাছটির কথা লেখেছিলেন তিনি তার ডায়েরি ‘দ্য ডায়েরি অফ আ ইয়ং গার্ল’ এ।  ১৯৪৪ সালের ১৩ মে তার ডায়েরিতে তৃতীয় বারের মত এই গাছটির কথা উল্লেখ করেন। ‘সাপোর্ট অ্যানা ফ্রাঙ্ক ট্রি’ ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘদিন দেখাশুনা করা হয় ইতিহাসের স্মারক এই গাছটিকে। ২০১০ সালের ২৩ আগস্ট প্রবল ঝড়ে গাছটি ভেঙ্গে পড়ে। সেই সময় গাছটির বয়স হয় আনুমানিক ১৫০ থেকে ১৭০ বছর। তবে পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এই গাছটির বীজ লাগানোর ব্যবস্থা করা হয়।

অ্যানা ফ্রাঙ্ক চেস্টনাট ট্রি, আমস্টারডাম

অ্যানা ফ্রাঙ্ক চেস্টনাট ট্রি, আমস্টারডাম

সেপ্টেম্বর ইলেভেন সারভাইভর ট্রি, নিউইয়র্ক

এবার আসছি ৯/১১ এর কথায়। ৯/১১ নিয়ে লিখতে গেলেই হাত শিউরে ওঠে। অনেক নির্মম ধ্বংস চিত্র চোখের সামনে ফুটে ওঠে। কম বেশি সবারই এই দিনটির কথা জানা। কিন্তু এই ধ্বংসযজ্ঞের মাঝেও একটি গাছ রয়ে গেছে সেই ভয়াল দিনের সাক্ষী হয়ে। গাছটি প্রজাতিতে ক্যালারি পিয়ার গোষ্ঠীর।

সেপ্টেম্বর ইলেভেন সারভাইভর ট্রি, নিউ ইয়র্ক

সেপ্টেম্বর ইলেভেন সারভাইভর ট্রি, নিউ ইয়র্ক

৯/১১ এর পর উদ্ধারকাজের সময় প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় গাছটিকে পাওয়া গিয়েছিল। ডালপালা ভেঙে চুরমার অবস্থা, শিকড়ের কোন অস্তিত্ব নেই। অনেকটা অংশ পুড়ে যাওয়া সত্ত্বেও গাছটিকে সিটি ডিপার্টমেন্ট এর আওতায় নিয়ে আসা হয়।  ধীরে ধীরে অনেক যত্নের পর গাছটিকে সুস্থ করে তোলা হয়। ২০১০ সালে ৯/১১ মেমোরিয়ালে গাছটি পুনরায় প্রতিস্থাপন করা হয়।  গাছটি ৯/১১ এর এক জীবন্ত সাক্ষী হয়ে রয়েছে যা দেখতে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ ভিড় করে নিউইয়র্ক এ ৯/১১ এর নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

বোধিবৃক্ষ, ভারত

গৌতম বুদ্ধের নাম শুনেনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুস্কর। আর বুদ্ধের সাথে জড়িয়ে আছে একটি  অশ্বত্থ (ডুমুর জাতীয়) গাছের নাম যা পরবর্তীতে বোধিবৃক্ষ নামে পরিচিতি লাভ করে। বিহারের বুদ্ধগয়ায় এই গাছটি অবস্থিত।

বোধিবৃক্ষ, ভারত

বোধিবৃক্ষ, ভারত

সিদ্ধার্থ গৌতম তখনও ‘বুদ্ধ’ হয়ে ওঠেন নি। সেই সময় সিদ্ধার্থ পৃথিবীর মানুষের দুঃখ দেখে বড্ড কষ্ট পান। তিনি এই দুঃখ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চান। সেই লক্ষে সিদ্ধার্থ সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। একদিন পৌঁছে যান উরুবেলায় (বর্তমান বিহারের গয়া)। সেখানে এই গাছটির নিচে বসে সাতদিন ধরে কঠোর তপস্যা করেন। এই তপস্যার ফলে সিদ্ধার্থ ‘বোধি’ বা পরম জ্ঞান প্রাপ্ত হোন। মহাবোধি মন্দিরের এই গাছ তাই ঐতিহাসিক তাৎপর্যের পাশাপাশি পবিত্র বলেও ধরা হয়ে থাকে।

কিন্তু ভগবান বুদ্ধ যে গাছটির নিচে বসে সাধনা করেছিলেন সেই গাছটি এখন নেই। বর্তমানে যে গাছটি রয়েছে সেটিকে সেই ‘পবিত্র’ গাছটির বংশধর হিসেবে ধরা হয়। বলাই বাহুল্য এই গাছটির প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের রয়েছে দুর্নিবার আগ্রহ। এই আগ্রহ মেটাতে মহার্ঘ এই গাছ দর্শনে দেশ বিদেশের প্রচুর লোক ভিড় করে এই বৃক্ষ তলে।

‘ইতিহাস’ শব্দটির মধ্যে সব সময় কোন কিছু না দেখাকে দেখা, না জানাকে জানার এক ধরনের আকুলতা বিরাজ করে। জানার আগ্রহ থেকে ঐতিহাসিক বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে আমরা জানতে চাই। শুধু যেন জানার মধ্যে জ্ঞান সীমিত থাকতে চাই না। জন্মায় চাক্ষুষ দেখার আগ্রহ। সে তো আর সম্ভব নয়। তার চাইতে বরং ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে যে সব গাছ এখনো বেঁচে আছে তাদের চোখ দিয়েই ইতিহাসের সেই সময়টাকে ধরার চেষ্টা করি।

Related Articles