Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দুর্ধর্ষ স্পাই মাতা হারির স্বপ্নভঙ্গের শেষ গল্প

মাতা হারি: দুর্ধর্ষ স্পাই পরিচয়ের আড়ালে এক স্বপ্নভঙ্গের গল্প (১ম পর্ব)

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ১০০ বছর আগে ১৯১৭ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মাতা হারির জীবনের নানান বাঁকের গল্প ছিল এই লেখার প্রথম পর্বে। যুদ্ধাহত এক তরুণ অফিসার ভ্লাদিমির দ্য ম্যাসলফ এর সাথে প্রেমের সম্পর্কের পর দু’জনার সুখের সংসার গড়বার স্বপ্নে বিভোর মাতা হারিকে জার্মানির বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য একরকম বাধ্য করেছিল ফ্রান্সের গোয়েন্দা অফিসার ক্যাপ্টেন গিওর্গি ল্যাঁদু। প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট হিসেবে মাতা হারিকে পাঠানো হয়েছিল বেলজিয়ামে। সেখান থেকে শুরু হল মাতা হারির জীবনের বেদনার দীর্ঘশ্বাসে ভারাক্রান্ত পরবর্তী জীবনের আলেখ্য।

mata hari 2
মাতা হারি, সাদাকালো ছবিতে শিল্পীর কল্পনায় রঙের মিশেল

বেলজিয়ামে গিয়ে মাতা হারির কাজ ছিল একজন প্রাক্তন প্রেমিকের মাধ্যমে সেখানে কর্মরত একজন জার্মান জেনারেলের সাথে পরিচিত হওয়া। সেই জেনারেলের সাথে প্রণয়ের অভিনয় করে তার মাধ্যমে মাতা হারি পৌঁছে যাবে জার্মানির ক্রাউন প্রিন্স যুবরাজ উইলহেম এর কাছে। আর যুবরাজের কাছ থেকে জার্মানির যুদ্ধসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করে পাঠাবে ফ্রান্সে। এ কাজের জন্য ল্যাঁদুর কাছে পারিশ্রমিক হিসেবে মাতা হারি দাবি করল এক মিলিয়ন গোল্ড ফ্রাঁ। ল্যাঁদু তাকে বলল হেগ শহরে যেতে, সেখানে একজন এজেন্ট তার সাথে যোগাযোগ করবে। সে যেন স্পেন হয়ে সেখানে যায়।

নভেম্বরের ৬ তারিখে মাদ্রিদে রাত কাটিয়ে পরদিন মাতা হারি জাহাজে রওনা হল। সেখানে ব্রিটিশ সৈন্যরা রুটিনমাফিক সার্চ করতে এল। কী নিদারুণ দুর্ভাগ্য তার! এক ব্রিটিশ কনস্টেবল অন্য এক ওয়ান্টেড তালিকাভুক্ত জার্মান স্পাইয়ের চেহারার সাথে মিল দেখে তাকে সেই নারী ভেবে গ্রেফতার করে বসল। লন্ডনে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হল তাকে। সেখানকার এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে মাতা হারি জানাল সে ল্যাঁদুর হয়ে কাজ কররছে। কিন্তু ল্যাঁদুর কাছ যখন খবর পাঠানো হল, সে জবাব দিল, মাতা হারিকে সে চেনে না এবং তাকে যেন স্পেনে ফেরত পাঠানো হয়। সম্ভবত নিজের গুপ্তচরকে ব্রিটিশদের কাছেই এভাবে গ্রেফতার হবার ঘটনা শুনে ল্যাঁদুকেই আবার ব্রিটিশরা বোকা ভাববে কিনা এই ভেবে ল্যাঁদু এই জবাব দিয়েছিল। ফলে ব্রিটিশদের আর কোনো সন্দেহ রইল না যে মাতা হারি জার্মান স্পাই!

তিন দিন পর মাতা হারিকে স্পেন পাঠানো হল। সেখান থেকে সে আবার ল্যাঁদুকে চিঠি লিখল তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে এবং নির্দেশনা জানতে চেয়ে। ল্যাঁদু কোনো জবাব পাঠাল না।

mata-1
মাতা হারি

তখন ১৯১৬ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ। মাতা হারিকে কোন নির্দেশনা পাঠায় নি ল্যাঁদু। এদিকে তার টাকা ফুরিয়ে আসছে ফলে মাদ্রিদ ছেড়ে যাওয়া আর সম্ভব নয়। তখন মাতা হারি ভাবল সে নিজ দায়িত্বেই জার্মানদের খবর ল্যাঁদুর কাছে পাঠাবে তাহলে হয়ত কোনো জবাব পেতে পারে। এই ভেবে সে জার্মান সামরিক দূত মেজর আর্নোল্ড ক্যালের বাড়িতে তার সাথে দেখা করার একটা ব্যবস্থা করল।

মাতা হারির সাথে দেখা হবার পর মেজর ক্যালে শুরুতেই তার কথাবার্তা শুনে ধরে ফেলেছিল তার উদ্দেশ্য। কিন্তু সেটা সে বুঝতে দেয় নি। প্রথম দিনই ক্যালে তাকে জানালো সে মরোক্কোর ফরাসী অঞ্চলে কিছু জার্মান ও তুর্কি অফিসারকে পাঠানোর জন্য একটা সাবমেরিন জোগাড়ে ব্যস্ত। সে রাতে মাতা হারি ল্যাঁদুকে লিখে পাঠালো এই তথ্য, সাথে ক্যালের উল্লেখ করা একজন জার্মান এজেন্টের নামও জানিয়ে দিল। এদিকে ল্যাঁদু এর আগেই সাবমেরিনের গল্প জেনে গিয়েছিল ফরাসি গোয়েন্দাদের মাধ্যমে, এটাও জানত যে এই গল্প আর এজেন্টের নাম দুটোই ভুয়া। আসলে মেজর ক্যালে চাইছিল মাতা হারিকে ফরাসিদের কাছেই ফাঁসিয়ে দিতে। গুপ্তচরবৃত্তিতে যাকে বলা হয় বিষাক্ত তথ্য প্রদান অর্থাৎ সত্য আর মিত্থ্যার মিশেলে কিছু মামুলি তথ্য দেয়া। তেমনটাই ক্যালে মাতা হারিকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছিল যাতে মনে হয় গুপ্তচর হিসেবে সে ফ্রান্সের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। আরও দু’দিন ধরে ক্যালে এভাবে তাকে তথ্য দিতে লাগল, সেও ওগুলো ফ্রান্সে পাঠালো, এদিকে ল্যাঁদু আগে থেকেই এসব তথ্য জেনে বসে আছে।

মাতা হারি ভাবতে লাগল সে হয়ত জার্মান মেজরকে বিশ্বাস করাতে পেরেছে যে সে জার্মান-অন্তপ্রাণ। সে বিশ্বাস আরও জোরালো করতে সে ফরাসিদের ব্যাপারে আড্ডা আর পত্রিকা থেকে নেয়া কিছু অগুরুত্বপূর্ণ তথ্য ক্যালের কাছে দিল। ক্যালেও খুশি হবার ভান করে বিনিময়ে তাকে কিছু টাকা দিল।

টানা তিন দিন গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করে মাতা হারি ভাবল সে হয়ত এর মধ্যে যথেষ্ট কাজ করেছে। এখন ফ্রান্সে ফিরে এই সফল অ্যাসাইনমেন্টের জন্য পারিশ্রমিক নেয়ার পালা। ১৯১৭ এর জানুয়ারির ৪ তারিখে সে প্যারিসে ফিরে দেখল ল্যাঁদু তার সাথে দেখাই করতে চাইছে না আর ওদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে ম্যাসলফ কোথায় আছে সেটাও সে জানে না।

mata 3মাতা হারি, ১৯১৫

১৯১৭ সালের শুরুর দিকে মিত্র বাহিনী হতাশ হয়ে পড়ছিল, বিশেষত ফ্রান্স। যুদ্ধের কারণে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি ব্যতীত কোনো অর্জনই তাদের আসে নি। কেবল ১৯১৬ এর ফেব্রুয়ারি থেকে জুন এই পাঁচ মাসে ফ্রান্স হারিয়েছিল সাড়ে তিন লক্ষ সৈন্য। মাতা হারির চারপাশ ভয়ঙ্কর অসহায় হয়ে উঠল। ল্যাঁদুর কোনো জবাব তো নেই, তার উপর ম্যাসলফের সাথে যখন তার দেখা হল, সে জানালো প্যারিসের রাশিয়ান অ্যাম্বাসি থেকে তথ্য পেয়ে তার কমান্ডিং অফিসার তাকে নিষেধ করেছে মাতা হারির সাথে সম্পর্কে না জড়াতে। আরও কয়েক সপ্তাহ ল্যাঁদুর খোঁজ করার পর তাকে জানানো হল ল্যাঁদুকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে অন্য এলাকায়। ইতিমধ্যে তার টাকাও শেষ হয়ে আসছিল।

এদিকে তার অজান্তেই আরও অনেক বড় দুর্গতি অপেক্ষা করছিল। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা জার্মান গুপ্ত তথ্য পাঠানোর সাইফার কোড জেনে ফেলেছিল এবং সেসব তথ্য মিত্র বাহিনীকে সরবরাহ করছিল। ১৯১৬ সালে জার্মানরা নতুন কোড বসিয়ে সেটাকে নিরাপদ ভাবলেও ব্রিটিশ গোয়েন্দারা সেই কোডের মর্মও উদ্ধার করে ফেলে।

ঘটনাটা জানার জন্য আবার ফিরতে হবে ডিসেম্বরে। মাতা হারি তখন মাদ্রিদে নিজ দায়িত্বে মেজর ক্যালের উপর গুপ্তচরবৃত্তি করছে। আইফেল টাওয়ারের উপর স্থাপিত রেডিওতে একটা মেসেজ এল ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে। সাইফার কোড উদ্ধার করে জানা গেছে মেজর ক্যালে তার উর্ধতন কর্মকর্তাদের তথ্য পাঠাচ্ছেন একজ ‘H21’ কোডধারী স্পাইয়ের দেয়া তথ্য অনুসারে, আর এসব তথ্য ফরাসি বাহিনীকে নিয়ে। ওই যে মাতা হারি কিছু হালকা ধরণের তথ্য দিয়েছিল মেজর ক্যালেকে, মনে আছে নিশ্চয়ই। যাই হোক, এই মেসেজ দেখে ল্যাঁদু ভাবল, ‘H21’ কোড পাওয়া মানে হল মাতা হারি নিজেকে জার্মানদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু সন্দেহ দানা বাঁধল এখান থেকে, মাতা হারিকে তো এই অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হয় নি, সে কেন এই কাজ করতে গেল? এরপরে আরেকটা উদ্ধারকৃত মেসেজে জানা গেল জার্মানরা ‘H21’ এর কাছ থেকে এসব তথ্যের ব্যাপারে আরও কিছু জানতে চেয়েছে। তখন ল্যাঁদু খানিকটা বিশ্বাস করতে শুরু করল যে মাতা হারি সত্যিই জার্মান স্পাই। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করল না তখনই। তাকে নজরদারিতে রাখা হল যাতে তার পিছু নিয়ে প্যারিসে জার্মান স্পাইদের নেটওয়ার্ক খুঁজে বের করা যায়।

জানুয়ারির মাঝামাঝি এসে ল্যাঁদু জানতে পারল এমন এক তথ্য যেটা দিয়ে সে চাইলেই বাঁচাতে পারত মাতা হারি কে। জানা গেল, জার্মানরা ব্রিটিশদের হাতে তাদের সাইফার কোড উদ্ধারের ঘটনা জেনে যাওয়ায় পরিকল্পনা করে ‘H21’ কোড দিয়ে মাতা হারির নামে তথ্য বিনিময় করেছে। যাতে এসব তথ্য উদ্ধার করে ফরাসীরা নিজেরাই নিজেদের স্পাইকে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে মেরে ফেলে।

ল্যাঁদু বুঝতে পারল মাতা হারি নির্দোষ কিন্তু সে এই তথ্যটা দিয়ে তাকে রক্ষা করল না। কে জানে কেন! হয়ত সে ভেবেছিল বিখ্যাত মাতা হারিকে গ্রেফতার করাটাই একটা বড় ধরণের ধাক্কা দেবে হতাশ হয়ে পড়া ফরাসি শিবিরে। যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ে না পেরে যত পারো শুধু স্পাইদের হত্যা কর- এটা দেখালেও সৈন্যদের অন্তত মনে হবে সরকার তাদের জন্য কিছু করছে। ফরাসি প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে স্পাইদের ধরার জন্য ক্রমাগত চাপ প্রয়োগও  হয়ত এর কারণ ছিল।

১৯১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারিতে মাতা হারিকে শত্রুশিবিরের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার করা হল। সামরিক প্রসিকিউটর পিয়েরে বুশার্ডনের কাছে মাতা হারি লিখিতভাবে জানাল, “আমি নির্দোষ। কেউ আমাকে ফাঁসাচ্ছে, হয়ত সেটা ফরাসি গোয়েন্দাসংস্থাই। কারণ আমি এর হয়ে কাজ করছি এবং কেবল এর নির্দেশনাই মেনে চলেছি।” মাতা হারিকে গ্রেফতারের খবর গোপন রাখা হল। সে ম্যাসলফ কিংবা কারো সাথেই দেখা করতে পারে নি। নিজের উকিল হিসেবে সে নিয়োগ দিল প্রাক্তন প্রেমিক এডুয়ার্ড ক্লুনেটকে। ৭৪ বছর বয়সী ক্লুনেটের সামরিক আইনের মামলায় অতটা দক্ষতা ছিল না এবং দীর্ঘ চার বছর সে কোনো মামলা লড়ে নি।

mata 1917
গ্রেফতার হবার পর মাতা হারি, ১৯১৭

বুশার্ডন এর কাছে মাতা হারির বিরুদ্ধে তোলার মত খুব গুরুতর কোনো অভিযোগ ছিল না। সে মাতা হারির মাদ্রিদে কিছু তথ্য দেয়ার কথা জানলেও জার্মানদের সাইফার মেসেজের ফাঁদ বানানোর ঘটনাটা জানত না। এর মধ্যে আবার বুশার্ডনের হাতে এল মাতা হারির গ্রহণ করা পাঁচ হাজার ফ্রাঁ এর তথ্য সম্বলিত একটা টাকার রশিদ এবং তাকে জানানো হল ‘গোপন তথ্য’র ভিত্তিতে জানা গেছে এই অর্থ জার্মানরা মাতা হারিকে দিয়েছে। যদিও মাতা হারি টাকাটা গ্রহণ করেছিল সত্যি, কিন্তু সেটা আসলে দিয়েছিল তার প্রেমিক সেই ডাচ ব্যারন।

বুশার্ডন সর্বাত্মক চেষ্টা করতে লাগলে মাতা হারির কাছ থেকে স্বীকারোক্তি নিতে। এদিকে জার্মানরা থেমে নেই তাদের কূটবুদ্ধি প্রয়োগে। তারা আবার মেজর ক্যালের কাছ থেকে মাতা হারির খবর জানতে চাইল যাতে তার বিরুদ্ধে ফরাসিদের সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। মাতা হারিকে গ্রেফতারের কথা জার্মানরা জানত, কিন্তু তার এমন ভান করল যেন দুই মাস পরেও তারা সে খবর জানে না এবং ফরাসিরা মনে করে জার্মান স্পাইরা অত্যন্ত দুর্বল।

মাতা হারি বারবার বোঝাতে চাইল সে নির্দোষ, জার্মানরা যুদ্ধের শুরুতেই তার সমস্ত কিছু কেড়ে নিয়েছে, সে তাদের পক্ষে কাজ করতে পারে না। কিন্তু তার কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকে দিল ল্যাঁদু। সে বুশার্ডনের কাছে জার্মান সাইফার কোড ভেঙে উদ্ধার করা তথ্যগুলো দিল কিন্তু এটা জানালো না যে এর মধ্যে ফাঁকটা কোথায়। এমনকি সে গোপনে বিচার সম্পন্ন করার পরামর্শ দিল।

prison
যে কারাগারে রাখা হয়েছিল মাতা হারিকে

এদিকে উকিল ক্লুনেট পাঁচ হাজার ফ্রা নেয়ার বিষয়টি পরিস্কার করতে ডাচ ব্যারনের সাক্ষ্য গ্রহণ করতে চাইল, কিন্তু আদালত তার অনুমতি দিল না। এরপর ক্লুনেট শেষ চেষ্টা করল ল্যাঁদু এবং বুশার্ডনের সাথে মাতা হারির সাক্ষাৎ করিয়ে তাদের বোঝানোর। মাতি হারি তখন জানালো অতীতের এক ঘটনা। ১৯১৬ সালের মে মাসের এক রাতে হঠাৎ তাকে ফোন করেছিল আমস্টারডমের জার্মান দূত ক্রোয়েমার। সে প্রস্তাব দিয়েছিল বিশ হাজার ফ্রাঁ এর বিনিময়ে জার্মানদের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতে। জার্মানরা তার সব কেড়ে নিয়েছিল তাই যত পারা যায় তাদের টাকা খসানো যাক, এই উদ্দেশ্য নিয়েই মাতা হারি সে টাকা নিয়েছিল। কিন্তু ঐ টাকা নেয়ার পর সে ক্রোয়েমারের সাথে দেখা বা কোনো কিছুই করে নি।

এ ঘটনা থেকে আসলে বোঝা যায় জার্মানদের মাতা হারির উপর এত ক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ। তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আবার তাদেরই বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তি করতে আসা মাতা হারিকে যাতে ফরাসিরাই হত্যা করে এজন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করছিল জার্মানরা। মাতা হারি স্বীকার করে সে খুব বেপরোয়া কাজ করেছিল, কিন্তু বারবার উচ্চারণ করে একটা কথা, “আমি পেশাদার স্পাই নই, আমি শুধু ভালোবাসা আর আনন্দ নিয়ে বাঁচতে চেয়েছি।” তবুও মন গলল না ল্যাঁদু আর বুশার্ডনের।

জুলাইয়ের ২৪ তারিখে বিচার বসল। বিচারক আন্দ্রে মর্নেট, একজন যুদ্ধকালীন লেফট্যানেন্ট। তখন যুদ্ধে ফ্রান্সের অবস্থা শোচনীয়। ইতিহাসের অন্যতম বিশাল সংখ্যক সৈন্য মারা পড়েছে তাদের । সাধারণ মানুষ ও সামরিক বাহিনীর লোকজন সকলেই হতাশ। এই অবস্থায় যুদ্ধের এই বিরাট দুর্গতির দায় অন্য কারও কাঁধে চাপানোর চেষ্টা করল ফরাসি সরকার। সে কাঁধটা হল বিদেশি গুপ্তচরদের। এর মধ্যে পাঁচশ বিদেশিকে গুপ্তচর সন্দেহে আটক করা হয়েছে যাদের মধ্যে তিনশ জনের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত। বিদেশি গুপ্তচরদের বিরুদ্ধে এই তোড়জোড়ের মাধ্যমে সরকার প্রমাণ করতে চাইছিল যুদ্ধক্ষেত্রের এই দুর্দশার দায় আসলে তাদের নয়, বিদেশি গুপ্তচরদের দুর্ধর্ষতার কারণেই এই পরিণতি হয়েছে।

mata-hari-trial
বিচার চলছে মাতা হারির

বিচারক মর্নেট আদালতে জানালো মাতা হারির উপরে নাকি দীর্ঘদিন কড়া নজরদারি রেখে জানা গেছে সে ফরাসি সামরিক অফিসারদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে তথ্য জোগাড় করত। তার ম্যাসলফের সাথে প্রেম, ব্রিটেনে গ্রেফতার হওয়া, H21 কোড পাওয়া ইত্যাদি সব খুঁটিনাটি বলে গেল মর্নেট। সে বলল, এই নারী পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম নারীদের একজন। সে অনেক ভাষা জানে, তার সুক্ষ অভিনয়, তার ঋজু চলন, বুদ্ধি, ধুরন্ধরতা এসব তার গুপ্তচরবৃত্তিতে ব্যবহার করেছে। মর্নেট প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করল বার্লিনের সেই পুলিশ অফিসার জার্মান গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্তাব্যক্তি এবং তার সাথে মাতা হারির সত্যিকারের প্রেমের সম্পর্ক আছে। সে বলল, “এই নারী কী পরিমাণ শয়তান তা অবিশ্বাস্য! সে সম্ভবত এই শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ নারী গুপ্তচর।”

মাতা হারির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ নেওয়া হল না। তার যুদ্ধরত এক পুরনো বন্ধু জেনারেল এডলফ পিয়েরে ম্যাসিমি লিখে পাঠিয়েছিল যে তার সাথে মাতা হারি কখনো যুদ্ধ নিয়ে কথা বলে নি। আরেক বন্ধু সেই মার্গুয়েরি তার পক্ষে সাক্ষ্য দিতে চাইলেও আদালত সুযোগ দেয় নি। মাত্র ৪০ মিনিটেই সাক্ষ্য-প্রমাণবিহীন এই বিচার সম্পন্ন করে আটটি অভিযোগে ১৯১৫ ও ১৯১৭ সালে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে মাতা হারিকে দায়ী সাব্যস্ত করা হয়।

মাতা হারি তার গুপ্তচরবৃত্তির জীবনে মাত্র তিনটি বিকেল বেলা সময় দিয়েছিল। মেজর ক্যালের কাছ থেকে কিছু ভুয়া তথ্য পাওয়া আর তাকে কিছু সাধারণ তথ্য দেওয়া ছাড়া সে আর কিছুই করে নি। জার্মানদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিল ঠিকই কিন্তু কোনো তথ্য তাদের সে দেয় নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান গুপ্তচরদের তালিকা ও তাদের স্মরণিকা খুজলে কোথাও মাতা হারির নাম পাওয়া যায় নি। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে তাকে হত্যার সুক্ষ পরিকল্পনা সফল হল।

১৫ অক্টোবর, ১৯১৭, সকাল বেলা। মাতা হারি তৈরি হল শেষ যাত্রার জন্য। তিনটি চিঠি লিখল সে। তার মেয়ে, ম্যাসলফ আর মার্গুয়েরির কাছে। জেল থেকে গাড়িতে তাকে নিয়ে যাওয়া হল ভিনসেন্স এর বড় মাঠটিতে। ১২ জন সৈন্যের একটি দল অস্ত্র নিয়ে তৈরি। মাতা হারি তার গায়ের কোটটা খুলে সাথে আসা নারী যাজকটিকে দিল। একজন অফিসার এল হাত ধরে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। মাতা হারি তার হাত ছাড়িয়ে একাই হেঁটে গেল গুলি করা হবে যে জায়গাটায় সেখানের দিকে। যেতে যেতে সে দেখছিল ১২ জন সৈন্যকে। সেখানে পৌঁছানোর পর একজন ক্যাপ্টেন তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ পড়ে শোনাল। একজন অফিসার এল তার হাত পিছনে বেঁধে দিতে। “তার দরকার হবে না”, বলল মাতা হারি। এরপর তার চোখে কালো কাপড় পরিয়ে দিতে চাইলে সেটাও নিষেধ করল। অফিসারটি অনুচ্চ স্বরে তার পাশে থাকা সৈন্যদলের অধিনায়ককে বল, “এই নারী জানে কীভাবে মরতে হয়।” অধিনায়ক হাত উঠিয়ে প্রস্তুত হতে বলল সৈন্যদের। মাতা হারি তাকালো সামনের দিকে। স্পষ্ট স্বরে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।” মৃদু হাসি দিয়ে এরপর হাতটা ঠোঁটে আলতো করে ছুঁয়ে একটা উড়ন্ত চুম্বন ছুঁড়ে দিল ফায়ারিং স্কোয়াডের অস্ত্র তাক করে রাখা সৈন্যদের দিকে। অধিনায়ক হাত নামিয়ে গুলির আদেশ দিল। গুলি হল ১১ টি। কারণ একজন সৈন্য অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল।

mata-hari-execution
চলচ্চিত্রের দৃশ্যে মাতা হারির মৃত্যুদণ্ড চিত্রায়ণ

সিনেমার দৃশ্যের মত মাতা হারি আঁতকে উঠল না। ধীরে ধীরে তার পা দুটো ভাজ হয়ে গেল। তখনও মাথাটা উঁচু করা। এরপর সে ঢলে পড়ল পেছনের দিকে। একজন সৈন্য এগিয়ে এসে রিভলবার বের করে গুলি করল তার মাথায়, মাতা হারি নিশ্চিত ভাবেই এবার বিদায় নিল অজানার উদ্দেশ্যে।

bell1917
মাতা হারির মৃত্যুদণ্ডের দিন সন্ধ্যায় এই ঘণ্টা বাজানো হয়

এভাবেই নির্মিত হল ইতিহাসের এক ট্র্যাজেডি নাটক। এই পৃথিবীতে মানুষ ইতিহাসের অনেক নারী কিংবা পুরুষকে বীর আখ্যা দিয়েছে, স্মরণ করেছে তাঁদের কীর্তির জন্য। কিন্তু মাতা হারির নামকে কোথাও বীর হিসেবে সম্মানিত করা হয় নি। কিন্তু মানুষের ইতিহাসে লেখা না থাকলেও পৃথিবী জানে, একটি সৈন্যের মৃত্যুর জন্যও সে দায়ী ছিল না, মাতা হারি বিশ্বাসঘাতক ছিল না, হৃদয়ের মানবতাকে সে হত্যা করে নি। মাতা হারি মিথ্যা অভিযোগে দুর্ধর্ষ স্পাই তালিকার শীর্ষে আসতে চায় নি, সে স্বপ্ন দেখেছিল সুখের সংসারের, সে বাঁচতে চেয়েছিল ভালোবাসা আর আনন্দ নিয়ে।

This article is in Bangla Language. It's about dramatic tale of mata hari exotic dancer and notorious wwi spy

Image Sources & References:

  1. http://www.eyewitnesstohistory.com/matahari.htm
  2. http://ic.galegroup.com/ic/suic/MagazinesDetailsPage/MagazinesDetailsWindow?zid=c59c508e24676db9e2868469013eac6c&action=2&catId=&documentId=GALE%7CA4224553&userGroupName=clea26856&jsid=dce44fb4bf2c07c6504558e16cb019ca
  3. http://mashable.com/2016/04/01/mata-hari/ https://en.wikipedia.org/wiki/Mata_Hari http://donhollway.com/matahari/

Related Articles